নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশালের নদ-নদী খাল-বিলে ঢুকে পড়েছে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি। গত কয়েক দিনে বরিশালের কীর্তনখোলা নদী ছাড়িয়ে তেতুলিয়া ও মেঘনা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত পানি, যা অর্ধ-শতাব্দীতেও দেখেননি বরিশালের মানুষ। নদীর পানিতে গোসল করলে চুল আঠা হয়ে যায়। এই পানি দিয়ে চা বানালে নোনতা লাগে। মৎস্য ও কৃষিসহ জীববৈচিত্রেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে দাবি পরিবেশবিদদের। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের। তারা বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখে কারণ অনুসন্ধানের কথা বলেছেন। উজানের পানির চাপ কমে যাওয়ার পাশাপাশি সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় লবণাক্ত পানি বরিশাল ছাড়িয়ে উত্তরাঞ্চলেও প্রবেশের আশঙ্কা পরিবেশবিদদের। পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আগেই প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে উজানের সকল নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবি তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। জোয়ার ভাটার তারতম্যের কারণে সমুদ্রে জোয়ারের সময় উপকূলীয় ২২ জেলার নদীতে ছড়িয়ে পড়তো সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি। বরিশাল জেলার নদ-নদীগুলো আগে মিঠা পানির নদী হিসেবেই ধরা হতো। কিন্তু গত সপ্তাহখানেক ধরে বরিশালের বিভিন্ন নদীতে লবণাক্ত পানির অস্তিত্ব পাচ্ছেন ব্যবহারকারীরা। কীর্তনখোলা ও তেতুলিয়া ছাড়িয়ে মেঘনা নদীতেও ঢুকে পড়েছে লবণাক্ত পানি। বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর তীরবর্তী মানুষ জানায়, গত ৫০ বছরেও এমন ঘটনা দেখেনি বরিশালের মানুষ। শুধু কীর্তনখোলা নয়, মেহেন্দিগঞ্জের মেঘনা নদীর পানিও লবণাক্ত হয়ে গেছে। ওই নদীর পানি দিয়ে বানানো চা-ও লবণাক্ত লাগছে বলে জানিয়েছে চায়ের ক্রেতা মো. রেজাউল কবির। পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ বরিশালের সংগঠক মো. মিজানুর রহমান জানান, উজানের পানি প্রবাহ হ্রাসের কারণে এবং সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলের ২২তম জেলা ছাড়িয়ে লবণাক্ত পানি ২৩তম জেলা হিসেবে বরিশালের নদ-নদীতে প্রবেশ করেছে। এর প্রভাব হবে মারাত্মক। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যায় পড়বেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সংগঠক মো. রফিকুল আলম বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন স্থান থেকে খবর পাচ্ছেন কীর্তনখোলাসহ বরিশালের বিভিন্ন নদ-নদীতে লবণপানির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। উজানের পানির ফ্লো কমে যাওয়ায় সাগরের নোনা পানি ধীরে ধীরে উজানের দিকে আসছে। এ ব্যাপারে এখনই সরকারকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে এবং সে অনুযায়ী করণীয় বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। লবণাক্ততার কারণে মিঠা পানির উৎস্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে কৃষি ও জলজপ্রাণীসহ জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করেন পরিবেশবিদ রফিকুল আলম। বরিশালের নদীতে মাত্রাতিরিক্ত লবণপানি প্রবেশ করায় বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী বায়োকেমিস্ট মো. মুনতাসির রহমান জানান, গত মার্চে কীর্তনখোলা নদীর পানির ইলেক্ট্রিক্যাল কন্ডাক্টিভিটি ছিল ১৩৬২ সিমেন্স পার মিটার কিউব। যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। বিষয়টি দুশ্চিন্তার। তারা আরও নমুনা সংগ্রহ করে তদারকি অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন। বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কামরুজ্জামান সরকার জানান, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কীর্তনখোলা নদীর ইলেক্ট্রিক্যাল কন্ডাক্টিভিটি খুবই কম ছিল। হঠাৎ করে মার্চে কীর্তনখোলা নদীর পানিতে ইলেক্ট্রিক্যাল কন্ডাক্টিভিটি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এটা দীর্ঘস্থায়ী হলে পরিবেশ ও প্রকৃতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা তার। উজানের নদীর পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনে ওইসব নদী খনন করে নাব্যতা বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি। অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে লবণাক্ত পানি প্রবেশের জন্য উজানের পানির ফ্লো কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূল বিদ্যা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. হাফিজ আশরাফুল হক। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে দেশের উত্তরাঞ্চলের নদী-নদীতেও সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তিনি। নদীতে লবণাক্ত পানির উপস্থিতি ঠেকাতে প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে উজানের সকল নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন উপকূল ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ ড. হাফিজ আশরাফুল হক।
Leave a Reply